অ্যানাল ফিস্টুলা বা ভগন্দর (Anal fistula) পরিপাকতন্ত্র – পর্ব ১০

Rf //; NCBI -( National Institutes of Health- UK ), Sir: Richard Cohen – (Cambridge University School of Clinical Medicine ) – Professor . AKM Fazlul Haque ( Colorectal Surgon, Bangabandhu Sheikh Mujib Medical University ) Cited & – Related articles Dr. Helal Kamaly ( Hon PhD Std Public health & Medical Science )
ফিস্টুলা বা ভগন্দর পায়ুপথের একটি রোগ। রোগটির জন্ম হয় মলদ্বারের বিশেষ ধরনের সংক্রমণের কারণে। ফিস্টুলা রোগ ক্যান্সারের চাইতেও ভয়ংকর। বাংলায় বলে নালি ঘা। যা ওষুধে ভালো হয় না। শেষপর্যন্ত অপারেশন লাগে। লক্ষণ অনুসারে অসুখটি প্রথম কয়েক বছর , কয়েকমাস পর পর দেখা দেয় বিঁধায় অনেকেই মনে করেন বিভিন্ন টুটকা চিকিৎসায় তা ভাল হয়ে গেছে ইত্যাদি বা অনেকের এভাবে ২০/২৫ বছর পর্যন্ত চলে যায় – রিসার্চ অনুসারে দেখা যায় শেষ পর্যন্ত তিনিদের আর ওপারেশন করে তেমন ভাল হওয়ার আশা থাকেনা বরং সার্জনদের কে বদনামি কয়ার হয় ।
আমার ব্যাক্তিগত মতে, যারা অ্যানালফেস্টুলা জাতিয় অসুখে আক্রান্ত তাহার অসুখটি ধরা পড়ার পর পায়ু পথ বিশেষজ্ঞ ছাড়া অন্য কোন চিকিৎসকের দ্বারা চিকিৎসা না করানোই সবচেয়ে উত্তম । এতে সময় এবং টাকা দুটিই বাঁচবে , কারন অবশেষে পায়ুপথ বিশেষজ্ঞ ছাড়া অন্য কেউ এই অসুখটি ভাল করা সম্বভ হয়না — ধন্যবাদ ( ডাঃ হেলাল কামালি – পি এইচ ডি ( পাবলিক হেলথ এন্ড মেডিক্যাল সাইন্স, শেষ পর্ব ) ————–
বিস্তারিত নিম্নে দেখুন ——————- ।
ভুমিকা ঃ

বেশির ভাগ রোগীই আগে মলদ্বারে ফোড়া হয়েছিল বা ভেতরে ফোড়া হওয়ার জন্য ফুলে যেত এবং ব্যথা হত বর্ণনা করেন । ক্রমান্বয়ে এগুলো ফেটে মুখ দিয়ে কিছুটা পুঁজ বের হওয়ার পর ব্যথা এবং ফুলা কমে যেত । এভাবে নি:সরণ বা পুঁজ পড়া মাঝে মধ্যে হয় আবার কখনো দুই-চার মাস এটি কমে যেত । এভাবে একটানা না থাকার কারণে অনেক সময় রোগীরা ভাবেন মনে হয় সেরে গেছে ইত্যাদি অথবা অন্যান্য টুটকা চিকিৎসার ফলে তা ভাল হয়ে গেছে, কিন্তু ৪/৫ মাস পর আবার সেই সমান সমস্যা যা একটু বেশি দেখা দিয়ে থাকে ইত্যাদি – এরপর জেনারেল চিকিৎসকের দ্বারা আর কিছুদিন চিকিৎসা করিয়ে থাকেন । অতঃপর পায়ুপথ বিশেষজ্ঞদের কাছে না যাওয়া ছাড়া আর কোন উপায় থাকেনা – তখন জরুরী অপারেশন করতে হয় – রেজাল্ড অনুসারে সে সময় রোগীকে অনেক কস্ট যাতনা সহ্য করতে হয় অথবা ৭০% এর বেলায় সম্পূর্ণ ভাল হওয়ার আসা ছেড়েই দিতে হয় — কারও বেলায় ১০/১৭ বছরের হিস্ট্রি ও থাকতে পারে ।
ফিস্টুলা এবং অ্যানাল ফিস্টুলা কি ?

চিকিৎসা বিজ্ঞানের পরিভাষায় ফিস্টুলা হচ্ছে দুইটি এপিথেলিয়াম প্রান্তের অঙ্গ বা ধমনী-শিরার মধ্যকার অস্বাভাবিক সংযোগপথ ( অর্থাৎ যে কোন এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে একটা নালীর মত সৃষ্টি হয় )
অর্থাৎ জীবাণু জনিত ইনফেকশন বা ফোঁড়া , ইনফ্লামেশন, ইনজুরি বা অপারেশনের কারণে কোন অঙ্গ (যেমন অন্ত্র বা পায়ু পথ ) যদি অন্য কোন অঙ্গের (যেমন ত্বক) সাথে সংযোগ নালীর সৃষ্টি করে তখন তাকে ফিস্টুলা বলে , বাংলায় অনেকে নালী ঘা বলে থাকেন ।
যে সকল দুটি অঙ্গ, অন্য একটি নালী বা ছিদ্রের মাধমে এক হতে দেখা যায় – যেমনঃ- ধমনী এবং শিরা , যৌন পথ এবং পায়ুপথ , সারভিক্স এবং যৌনপথ, শ্বাস নালী এবং কন্ট নালী, সাইনাস এবং স্কাল- ঠিক তদ্রূপ পায়ুপথের সাথে আশেপাশের ত্বকের সাথে অস্বাভাবিক সংযোগ নালী তৈরী হলে , তাকে অ্যানাল ফিস্টুলা বা ভগন্দর বলা হয় ।
ফিস্টুলা কে অঙ্গের নাম অনুসারে সেই অসুখের নাম করন করা হয়ে থাকে-যেমন, এট্রিওভেনাস ফেস্টুলা ( Arteriovenous fistula ) ,গ্যাস্ট্রোইনটেসটিনাল ফেস্টুলা , অ্যানাল ফেস্টুলা , অবসটেট্রিক বা জেনিটাল ফেস্টুলা ইত্যাদি এবং এর মধে সবচেয়ে বেশি কষ্টদায়ক হচ্ছে জেনিটাল বা ভেজিনাল ফেস্টুলা ( জেনিটাল ফিস্টুলা হলো যোনির সাথে মূত্রথলি বা মলাশয়ে যখন এক বা একাধিক ছিদ্র দিয়ে যুক্ত হয়যার ফলে যোনি দিয়ে পায়খানা বা প্রস্রাব ঝরে– বিস্তারিত ধাত্রী বিদ্যা পরবে দেখুন )
কারন ঃ

যদি ও একাদিক কারন থাকতে পারে তবে তার মধ্যে ৬৩% দায়ী করা হয় মলদ্বারের বিশেষ ধরনের সংক্রমণকেই । যেমন মলদ্বারের ভেতরে অনেক গ্রন্থি রয়েছে, এগুলোর সংক্রমণের কারণে ফোড়া হয়। এই ফোড়া এক সময় ফেটে গিয়ে মলদ্বারের চতুর্দিকের কোনো এক স্খানে একটি ছিদ্র দিয়ে বের হয়ে আসে এবং পুঁজ নির্গত হতে থাকে এবং তা নালী হয়ে বাহিরের দিকে বের হয় যা দেখতে পোড়ার মত মনে হয় ।
( কেউ কেউ মনে করেন কৃমির বাসা থেকে এর উৎপত্তি ! আসলে তা ঠিক নয় তবে কৃমির উপদ্রবের কারনে নুখ দিয়ে চুলকাতে গিয়ে অনেক সময় পায়খানার রাস্থার ভিতরে ইনফেকশন বা ছিদ্র হয়ে হতে পারে )
Diverticulitis – বৃহদান্ত্রের (কোলন) পাশে ছোট থলির ইনফেকশন। ইনফ্লামেটরি বাওয়েল ডিজিজ (Inflammatory bowel disease- IBD)-এর একটি প্রকার হলো Crohn’s disease ।
অ্যানাল ফিস্টুলা আরও অন্যান্য যে সকল কারনে হতে পারেঃ
মলাশয় বা পায়ুপথের ক্যান্সার অথবা বৃহদান্ত্রের প্রদাহজনিত জনিত কারনে,
যক্ষ্মা জীবাণুর কারনে ( যদিও এর কারনে প্রধানত ফুসফুসে ব্যাকটেরিয়ার ইনফেকশন ঘটে বা সেখানে ফিস্টুলা হওয়ার সম্বাভনা শতভাগ , কিন্তু পরবর্তীতে শরীরের বিভিন্ন অংশে ছড়িয়ে পড়তে পারে বিশেষ করে মল দ্বারের পায়ু পথকে ছিদ্র করতে পারে )
এইচআইভির আক্রমণে , ক্ল্যামিডিয়া (Chlamydia)ঃ ( যা যৌন মিলনের মাধ্যমে ইনফেকশন হয়ে থাকে এবং সাধারণত প্রাথমিক অবস্থায় অন্য কোন উপসর্গ দেখায় না) সিফিলিস ( যা রক্ত বা যৌন সম্পর্কের মাধ্যমে ছড়ায় ) , পুরাতন আলসারেটিভ কোলাইটিস, অপারেশনের জটিলতা অথবা ভুল অপারেশন ইত্যাদি কারনে অ্যানাল ফিস্টুলা হতে পারে ।
ফিস্টুলার প্রকারভেদঃ ( Intersphincteric fistula- Transphincteric fistula. Suprasphincteric fistula. Extrasphincteric fistula )

ফিস্টুলা প্রধানত চার ধরনের হলেও মুলত দুই ধরনের ঃ
১. এনাল স্ফিংটারের নিচে ফিস্টুলার ভেতরের মুখের অবস্থান হলে তাকে নিচ বা লো ফিস্টুলা অথবা সাধারণ ফিস্টুলা বলা হয় । ( পায়ু পথের নিকটে )
২. স্ফিংটারের ওপর অবস্থান হলে তাকে ওপর বা হাই ফিস্টুলা অথবা জটিল ফিস্টুলা বলা হয় । ভেতরের মুখ যত ওপরে থাকে তার চিকিৎসা পদ্ধতি তত জটিল ও কষ্টসাধ্য হয়ে থাকে এবং ইহা নির্ভর করে এর শেকড় মলদ্বারের মাংসের কতটা গভীরে প্রবেশ করেছে তার উপর । এপর্যায়ে প্রধান সমস্যা হচ্ছে বিশেষজ্ঞরা সঠিকভাবে অপারেশন করতে ব্যর্থ হলে ৮৬% বেলায় মল আটকে রাখার ক্ষমতা হারিয়ে ফেলতে পারেন ।
ফিস্টুলার লক্ষণঃ

ফিস্টুলা বা ভগন্দর রোগের লক্ষণ মূলত তিনটি।
১. মলদ্বার ফুলে যাওয়া বা বা চাকা অনুভব করা (Mass or swelling around the anus)
২. মলদ্বার ব্যথা হওয়া (Pain of the anus)
৩. পুঁজ বা আঠাল পদার্থ বের হওয়া। (Discharge in Stool)
একি সাথে অন্যান্য যে সকল লক্ষণ দেখা দিতে পারে যেমন,
পেটে তীক্ষ্ণ ব্যথা (Sharp abdominal pain),মলের সাথে রক্ত যাওয়া (Blood in stool), মলদ্বার দিয়ে রক্তক্ষরণ (Rectal bleeding), পিঠের নিম্নাংশের মাংসপেশীতে টান বা খিঁচুনি দেখা দেওয়া (Low back cramps or spasms), শরীরের নিম্নাংশে ব্যথা (Lower body pain), কোষ্ঠকাঠিন্য (Constipation),
অনৈচ্ছিক মলত্যাগ (Incontinence of stool), অণ্ডথলিতে চাকা/পিণ্ড (Mass in scrotum) অনুভব করা ইত্যাদি ।
সে সময় অনেকে বলে থাকেন মলদ্বারের চারপাশের ত্বক জ্বলা অনুভব করিতেছেন যা নড়া চড়া বা কাশি দেওয়ার সময় কম্পিত খিঁচুনি জাতীয় মোচড়ানো ব্যাথা অনুভুতি হয় , ফোঁড়া বা ইনফেকশন জনিত হলে প্রচন্ড জ্বর ( (100.4F) অবসাদ এবং রক্ত পুঁজ আসতে থাকবে, অন্ত্রের হজম জনিত কারনে, ভায়েল সিন্ডোম বা আলসারেটিভ কোলাইটিস জনিত কারনে হলে , পেটের ব্যাথা ও অন্যান্য লক্ষণ সহ ডায়রিয়া, ক্ষুধামান্দ্য, ওজন কমে যাওয়া , বমি বমি ভাব (অনুভূতি অসুস্থ) বমি দেখা দিতে পারে ।
চিকিৎসা না করা হলে এই প্রক্রিয়া বৎসরের পর বৎসর চলতে থাকে এবং মলদ্বারের চতুর্দিকে এক বা একাধিক মুখ দেখা দিতে পারে। তিন থেকে ছয়টি মুখ পর্যন্ত দেখা যায়
ডায়াগনোসিসঃ

( মনে রাখবেন এই অসুখে ভুল ডায়াগনোসিস হলে অসুখটি কোন দিন ই পূর্ণ ভাল হওয়ার আসা করা ঠিক হবেনা বিধায় অসুখটির প্রথম থেকেই পায়ু পথ বিশেষজ্ঞের পরামর্ষে ডায়াগনোসিস করা উচিৎ )
যদিও বিজ্ঞ চিকিৎসকরা বাহিরের দিকের ভগন্দের মুখে আঙ্গুলের টিপ দিয়েই বলতে পারেন এটা ফেস্টুলা না অন্য কিছু ( সাধারণত ফিস্টুলার মুখ দেখতে পুঁজ যুক্ত লাল দেখায় অথবা একি সাথে রক্ত মিশ্রিত ও থাকে ) অথবা সাধারন ফেস্টুলা হলে পায়ুপথের পরিক্ষা করেই ইহা কোথা থেকে শুরু তাও যে কোন চিকিৎসক এনোস্কোপ দিয়ে দেখে নিতে পারেন – কিন্তু ফিস্টুলা স্ফিংটারের উপরের দিকে অবস্থান হলে তা কোন ভাবেই নিখুঁত অবস্থান নির্ণয় করা অনেক সময় সম্বভ হবেনা বিধায় নিম্নের বেশ কয়েকটি পরীক্ষা করার প্রয়োজন হতে পারে —সিগময়ডোস্কপি অর কোলনস্কপি (Sigmoidoscopy or colonoscopy), অ্যানো-রেক্টাল এক্সামিনেশন (Ano-rectal examination), এনোসকপি (Anoscopy)ফিস্টুলোগ্রাফি (Fistulography) ইত্যাদির মধ্যে ফিক্সেবোল সিগময়ডস্কপি ( মনিটারের মাধ্যমে নিখুঁত ভাবে দেখা হয় ) ই সবচেয়ে উত্তম ।
চিকিৎসা ঃ

অপারেশনের পূর্ব মুহূর্তে বিশেষজ্ঞরা ভাল এন্টিবায়োটিক ঔষধ সেবন করার জন্য দিয়ে থাকেন ( নরম টিস্যুর ঘা শুঁকানোর জন্য ) , সেই সাথে মল নরম হওয়ার জন্য তরল সিরাপ জাতিয় ঔষধ এবং কিছু খাবার দাবার যা পায়খানা শক্ত করে , তা থেকে বিরত থাকার জন্য পরামর্শ দিয়ে থাকেন । ( ciprofloxacin, ispaghula husk, methyl cellulose, metronidazole ইত্যাদি )। তবে- যক্ষ্মা , পরিপাকতন্ত্রের প্রদাহজনিত রোগ, ডায়াবেটিস –পায়ুপথে ক্যান্সার ইত্যাদি অন্য কোন অসুখ থাকলে অবশ্যই তা আগে নিয়ন্ত্রণ করতে হবে ।
নতুন পদ্ধতি অনুসারে সার্জারি ছাড়া, বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকরা ফাইব্রিন গ্লূ ইঞ্জেকশন পদ্ধতি ব্যবহার করে ৭৭% রোগীকে ভাল করতে সক্ষম । তারপর ও ১৪% বেলায় ১৬ মাস পর আবার দেখা দিতে পারে । ( ইনজেকশনের মাধ্যমে কোলাজেন প্রোটিন দিয়ে ফেস্টুলার নালীকে সম্পূর্ণ সিল-গালা লাগানোর মত বন্ধ করে দেওয়া হয় যাতে উক্ত নালী দিয়ে পুঁজ বা অন্যান্য দূষিত পদার্থ না আস্তে পারে )

রিসার্চ অনুসারে এখন পর্যন্ত সার্জারিই ফিস্টুলার একমাত্র চিকিৎসা, যা ৯১% ভাল হওয়ার আসা করতে পারেন যদি অসুখটি দীর্ঘদিনের পুরাতন না হয় । সাধারণত ওপারেশনের মাধ্যমে অস্বাভাবিক সংযোগটি সম্পর্ণভাবে তুলে আনতে হয় এবং তখন যদি কোনো অংশ থেকে যায় তাহলে এই অসুখটি আবার হওয়ার আশঙ্কা থেকেই যায় যা পরবরতিতে জটিল আকারও ধারণ করতে পারে ।
সার্জনরা ডায়রেক্ট অপারেশনের সাথে কয়েক ধাপে সিটন পদ্ধতি সহ এন্ডোরেকটাল এডভান্সমেন্ট ফ্লাপ ব্যবহার করে থাকেন ( সিল্ক সুতা ভিতরের দিকে ঘিরে তার উপর বিশেষ স্পঞ্জের দ্বারা নির্মিত একটি ত্রিভুজ আকৃতির স্তম্ভ নালীর ভিতর ঢোকিয়ে সেলাই করে রাখা হয়- ( Seton stitch) , তখন নালী ঘা খুব তাড়া তাড়ি শুকিয়ে যায় যা সার্জনরা কয়েক ধাপে করে থাকেন । মেডিক্যাল জার্নাল অনুসারে ফিষ্টুলা ওপারেশনের পর সার্জনদের যত বদনাম হয় অন্য কোন ধরনের ওপারেশনে এত বদনাম হয়না ।
( আর ও বিস্তারিত জানতে আপানার নিকটস্থ একজন অভিজ্ঞ কলোরেক্টাল সার্জনের সাথে বুজে নিতে পারেন )
ধন্যবাদ ( চলবে )
No comments:
Post a Comment